জরূরী প্রয়োজনে গ্রামে যেতে হবে এরকম কারণ দেখিয়ে। তার পর সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ফিরে এল ঘন্টা দুই পরে তার স্বাভাবিক গেট আপ এ। অমিত রিলিজ হবে বেলা এগারটায়। ম্যাগী আর বিন্দু ছাড়া সবাই এসেছে। বিন্দু অমিতের জন্য ঘরদোর গোছগাছ করছে। তাকে সহযোগিতা করছে ম্যাগী।
ঠিক হয়েছে এবার মনি শংকরের বাড়িতে উঠবে অমিত। বন্যা খুব মন খারাপ করেছিল। বিন্দুর কথায় শেষ পর্যন্ত থেমেছে। যে কদিন অমিত মনি শংকরের বাড়িতে থাকবে সে কদিন বন্যাও সেখানে থাকবে। এতে বিন্দুর আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। মেয়েটাকে সে যে কি পরিমাণ ভালবাসে তা কল্পনারও বাইরে। নিজের সন্তান থাকলে তাকেও বোধ হয় এতটা ভালবাসতো না। মনি শংকরও তাকে ভালবাসে। রাশভারী মনি শংকর বন্যার সাথে হয়ে যায় শিশু।
ঘর গোছাতে গোছাতে শিস বাজাচ্ছে বিন্দু। ম্যাগী তাকে সহযোগিতার নামে ঝামেলাই করছে বেশী। এটা ওখানে রাখ, ওটা সেখানে রাখ। এরই মাঝে ঘরের পর্দা পাল্টেছে তিনবার। শেষমেষ অস্থির হয়ে বিন্দু ধমক দিলো, “হ্যারে ম্যাগী, এত জ্বালাতন করছিস কেন বলতো? আমার দেবরকে আমি যেভাবে রাখি সে সেভাবেই থাকবে।”
“তাই নাকি? খুব ভাবছিল তোমাদের মাঝে তাই না?”
“ওমা সেকি কথা! থাকবে না কেন? ছোট ঠাকুরপো ছিল আমাদের বাড়ির প্রাণ।”
“আর তুমি ছিলে তার প্রাণ ভোমড়া।”
প্রস্তুত ছিল ম্যাগী। তাই সময় মত সরে যেতে পেরেছে বিন্দুর থাপ্পড় থেকে। তাদের খুনসুটি দেখে বুঝার উপায় নেই দুজন পৃথিবীর দুই গোলার্ধের বাসিন্দা। তাদের মাঝে না আছে কোন সম্পর্ক, না আছে কোন সাদৃশ্য। তবুও কি সুন্দর পারিবারিক আবহ।
“দাঁড়া এবার ঠাকুরপোকে লাগাবো তোর পিছনে।”
“তোমার ঠাকুরপোকে আমার সামনে পিছনে কোনদিক থেকেই লাগাতে পারবে না।”
“ছি! কথার কি ছিরি দেখ? এই ঢ্যামনি তোর কি লজ্জা শরম বলে কিছু নেই?”
“হুম! কৃষ্ণ করলে লীলা আর আমি করলে দোষ, তাই না? আচ্ছা মেজবৌদি তোমার ছোট ঠাকুরপোর বিযে দিচ্ছ না কেন?”
“দেব, এবার নিশ্চই দেব। ভাল একটা মেয়ে খুজেঁ পেলেই দেব। আছে নাকি তোর খুজেঁ কোন মেয়ে?” হঠাত বিন্দুর খেয়াল হলো এ বিষয়ে ম্যাগী কেন কথা বলছে। এটা তো তার বিষয় নয়। পাহারা দিতে গিয়ে আবার প্রেমে পড়েনিতো মেয়েটা?
“এই তুই ঠাকুরপোর বিয়ে নিয়ে এমন উতলা হলি কেন রে? ওর প্রেমে পড়িস নি তো?”
“সে আর বলতে। জনম জনম ধরে তোমার ঠাকুরপোর প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচিছ।”
উফ তোর ঢ্যামনামি আর গেল না।”
“শুন মেজবৌদি, সুযোগটা দ্বিতীয়বার নাও আসতে পারে তাই সময় থাকতেই বলে রাখছি, তোমার ঠাকুরপো অঞ্জলীদির প্রেমে মজনু হয়ে আছেন গত দেড় যুগ ধরে।
“সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করবি নাতো! অঞ্জলী আমাদের পরিবারেরই একজন প্রায়। ওতো ঠাকুর পোর চে বয়সে বড় আর বাল বিধবা।”
“যিশুর কিরে বৌদি, এটা ঠাট্টা নয় ।
“তুই জানলি কি করে?”
“আমি সাংবাদিক, আমাকে জানতে হয়। জানাটাই আমার কাজ।
“হায় ভগবান, বলিস কি রে হতচ্ছারী?
“অঞ্জলীদি সারা জীবন আই বুড়ো থেকে গেলেন সেতো তোমার ছোট ঠাকুরপোর জন্যই।”
“ওমা সে কি জানতো নাকি যে ঠাকুরপো পনের বছর পরে তার জন্য দেশে ফিরে আসবেন?”
“সে তারমত অপেক্ষা করে গেছে, আসলে আসবে না আসলে নাই।”
“কিন্তু অঞ্জলীও তো বিয়েথা করে সংসারী হয়ে যেতে পারতো। তার সাথে তো ঠাকুরপোর যোগাযোগ ছিল না।”
“তোমার ঠাকুরপোও সে ঝুকি নিয়েই অপেক্ষা করেছে।”
“তোর কথা যদি সত্যি হয় তবে শীঘ্র্ই আমি দুটির চার হাত এক করে দেব।”
“তাই দাও। এ যুগে এমন পৌরাণিক প্রেম খুব বিরল।”
“আচ্ছা তুই এত খবর যখন জানিস তো বল দেখিনি তোর বস কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে?”
“আমার বস একজন সিংহ হৃদয় একজন মানুষ মেজ বৌদি। মাথা কাজ করে কম। হৃদয় কাজ করে বেশী। তাই লাইনে থাকতে পারেন না। বখে যাওয়া ধনীর দুলাল, যাকে তুমি আবার লাইনে ফিরিয়ে এনেছ।”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিন্দু এই বিদেশী মেয়েটার দিকে। তার চোখ কি কিছুই এড়ায় না?চারটে গাড়ি। রোহিতের শেভ্রোলে, মনি শংকরের বিএমডব্লিউ, মঞ্জুর পোর্সে আর অঞ্জলীর বেন্টলী। শেভ্রোলেটা অমিত নিজে ড্রাইভ করে, অঞ্জলীও বেন্টলী নিজে ড্রাইভ করে। মনি শংকর আর মঞ্জুর গাড়ী চালায় ড্রাইভার। সকলে মিলে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল অমিত শেভ্রোলে নিয়ে মাঝখানে থাকবে। তার সাথে থাকবে বন্যা। সামনে মনি শংকর। পিছনে মঞ্জু আর রোহিত। আর সবার পিছনে থাকবে অঞ্জলী। হাসপাতালের সকল ফরমালিটিজ শেষ হবার পর কিছু রয়ে গেছে কিনা সেটা দেখার জন্য অঞ্জলী ফিরে গেল অমিতের কেবিনে। ভিতরে ঢুকে মনি শংকরকে মেসেজ দিল, “দাদা, কাউকে বুঝতে না দিয়ে অমিতের কেবিনে একবার আস। এক্ষুণি।”
অঞ্জলীর দুঃসাহস দেখে মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল মনি শংকরের। তার পরও চুপ থাকলো। খুব ক্যাজুয়াল ভংগীতে অমিতের কেবিনে ঢুকলো। ঠোটে আংগুল রেখে অঞ্জলী মনি শংকরকে কথা বলতে নিষেধ করলো। তার পর নোট প্যাড নিয়ে দ্রুত লিখলো, “দাদা অতীতের কথা ভুলে যাও। অমিতকে ভালবাস তাই বলছি। কাল রাতেও অমিতের উপর অ্যাটেম্পট হয়েছে। আমার ধারণা আবারও হবে এবং সেটা পথে হবার সম্ভাবনাই বেশী। আগের পরিকল্পনা বাদ দাও। শেষ মূহুর্তে অমিতকে নিয়ে তুমি আলাদা গাড়ীতে উঠ।”
শত্রু-মিত্র যাই হোক অঞ্জলীর বুদ্ধির উপর তার আস্থা আছে। আর যেহেতু মনি শংকর নিজে সাথে থাকবে কাজেই অঞ্জলীর পরিকল্পনা মেনে নিল। গাড়ি ছাড়ার একদম শেষ মূহুর্তে পুলিশ জীপ নিয়ে সুব্রত এসে হাজির হলো। নিজেই ড্রাইভ করছে। স্টার্ট বন্ধ না করেই মনি শংকর আর অমিতকে বললো, “উঠে পড়ুন, কুইক।” কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সাঁ করে বেরিয়ে গেল সুব্রত। পিছন পিছন গেল মনি শংকরের গাড়ি। ড্রাইভার একাই আছে সেটায় । তারপর মঞ্জু আর রোহিত তাদের পোর্সেতে।এবং সবশেষে অঞ্জলীরসাথে বন্যা। শেভ্রোলেটা পরে রইল হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সকলেই খুব দ্রুত সুব্রতকে ফলো করছে। তারা এক কিলোমিটারমত গিয়েছে কি যায়নি, বিকট শব্দে হাসপাতালের সামনে বিস্ফোরিত হলো রোহিতের শেভ্রোলে। টাইম বোমা ছিল গাড়িতে।
দশ মিনিটের মধ্যে মনি শংকরের বাড়ির সামনে পৌছে গেল গাড়ির বহর। লাফ দিয়ে নামলো অমিত আর মনি শংকর। অন্য গাড়ি গুলি থেকে প্যাসেঞ্জাররা এখনও নামা শুরু করেনি সুব্রত রওয়ানা দিল হাসপাতালের পথে। বিস্ফোরণের শব্দ তাদের কানে যায় নি। তবে ওয়াকি টকিতে কোডেড মেসেজ পেয়েছে সুব্রত। হাসপাতালের সামনে পৌছে দেখল বিরাট জটলা। প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা ক্যামেরা হাতে ব্যস্ত। সে নামতেই সবগুলি ক্যামেরা ঘুরে গেল তার দিকে। হরবর করে প্রশ্ন করছে সবাই। “শেষ মূহুর্তে আপনি ড. অমিতাভ রায় চৌধুরীকে লিফট দিয়েছেন। আপনি কি আগে থেকেই জানতেন এরকম কিছু ঘটবে।” সুব্রত জবাব দিল না। দুজন কনস্টেবল আর একজন হাবিলদার ছিল সেখানে। তাদের কাছ থেকে জানলো কেউ হতাহত হয়নি। আশেপাশের দুএকটা দোকানপাটের কাচঁ ভেংগে গেছে। আর গাড়িটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। অনুসন্ধানী চোখে জায়গাটা জরীপ করছে সুব্রত। কোন আলামত পাওয়া যায় কি না। হঠাত করেই তার হাতের রুমালটা পড়ে গেল। কেউ লক্ষ্য করলো না রুমাল তুলার সময় এর সাথে একটা ফেঠে যাওয়া পিতলের টুকরাও ঢুকে গেল সুব্রতর পকেটে।
আবারও ছেকে ধরলো সংবাদকর্মীরা। সুব্রত শুধু বললো,” আমি কিছু জানতাম না বা অনুমান করিনি। রুটিন পেট্রোলে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভিভিআইপি লোকদের গাড়ি বহর দেখে ইনস্টান্টলী লিফট দেবার প্রস্তাব দেই। তারাও রাজী হন। থ্যাংক গড। একটা দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেল।” নমস্কার জানিয়ে গাড়িতে উঠে গেল সুব্রত। আসলে তাকে ফোন করে ডেকে এনেছিল অঞ্জলী। গোপনীয়তার জন্য কারো সাথে কিছু শেয়ার করেনি।